আমার খুব শখ আমি এমন বাড়িতে থাকি যেখানে, গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ থাকবে। জন্ম সূত্রে আমরা এমন শহুরে যে, আমার বাবা মা কখনও গ্রামে থাকেনি, গ্রাম দেখেনি, ফলে আমারতো কোন আশাই নাই। পুরানো ঢাকার পুরানো বাসায় বড় হবার সুবাদে, তবু কিছু গাছ-পালা দেখেছি। পেয়ারা গাছে উঠেছি, মেহেদি পেড়ে বেঁটে হাতে লাগিয়েছি, ফুল লাগিয়েছি, বাগান করেছি। কিন্তু বর্তমানে পুরানা পল্টনের সেই দোতলা বিশাল বাড়িটা নাই, আমার পেয়ারা গাছও নাই আর সাধের বাগানও নাই।
ঢাকার ফ্ল্যাট বাড়ির কোনায় পড়ে থাকা বারান্দাই আমার শেষ ভরসা। তাই সেখানে টবে টবে গাছ লাগিয়েছি। পাশের বিশাল বিল্ডিং ভেদ করে সকালে কিছু রোদ পাই, কিন্তু তা দিয়ে ফুল ফোটানো, ছেলেদের পেটে বাচ্চা হবার মতই অসম্ভব। তারপরও আমার মালির ভিটামিন আর ওষুধের জন্য কখনও শখনও দুই একটা ফুল ফোটে বৈকি। কখনও টগর, বেলি, জবা, কামিনী, গন্ধরাজ, বাগানবিলাস, লিলি ইত্যাদি। আবার মাঝে মাঝে তুলসি, লেবু আর দুই একটা ঔষধি গাছের পাতা ছিড়ে ভণ্ড কবিরাজি করি। আর আছে এক টবে ঘাস। জবা কামিনির মতই আমার প্রিয়, সবুজ চিকন পাতার ঘাস। ঘাসের টবে হাত বুলাই আর মনে মনে ভাবি, এই বুঝি আমার সাধের বাগান, আমি হাঁটছি, নরম ঘাসে পা রাখছি, মনের লন আমার। একটা ছোট টবে এক টুকরা ঘাসের প্রতি আমার আহ্লাদ দেখলে আমার বর হাসে। আমি যখন বেড়াতে যাই আগেই শর্ত থাকে, যেন কোন ইকো রিসোর্টে না যাই। গ্রামে বড় হওয়া বরের ইকোকে এডভেঞ্চার মনে হয় না, যন্ত্রণা মনে হয়। ও বুঝে না, ছোট বেলায় গ্রাম না দেখার লোভ আমার আজও যায়নি। ও বুঝে না, সত্যি আমি চাই গ্রামে থাকতে। তবে আজকের জামানায় গ্রামে থাকতে সাহস লাগে। ছেলে সানবিমস-এ না পড়লে যেহেতু পাড়ায় আমার মান থাকে না, তাই অগত্যা কোনার বারান্দার এক টুকরা ঘাসই সই।
ভাগ্যক্রমে গ্রামের ছেলের সাথে বিয়ে হওয়াতে আমি, আমার বাপ-মা সবাই অন্তত গ্রাম দেখলাম। যে বাড়িতে আমার বিয়ে হয়েছে, সে বাড়িতে ধান আসে, বতর আসে, গরুর দুধ হয়, মুরগি ডিম পাড়ে, নিজের গাছেই হয় মধু, পুকুরে আছে মাছ, ক্ষেতে আছে সাক-পাতা সব্জি। আমার শাশুরি আদর করে পেঁপেটা লাউটা, দেশি মুরগির ডিম, ফরমালিন ছাড়া পুকুরের মাছ, ক্ষেতের পেয়াজ পাঠায়। আমি মহা-সমারহে মা-কে দেই, নিজেও খাই। বলি মা, দেখো, দেশের থেকে আসলো, একদম ফ্রেশ।
আমার বড় শখ, আরশান বড় হয়ে গেলে আমি বাঁশগ্রামে চলে যাব। আমার ক্ষেতের শাক-পাতা, পেয়াজ, ধান-চাল নিয়ে থাকব। আমার বারান্দায় রোদ আসবে এত যে আমি বলব, এত রোদে কি কাজ করা যায়, বৃষ্টির দিনে পা টিপে টিপে হাঁটব আর বলব কোন ভুতের প্রভাবে যে গ্রামে আসছিলাম, কিন্তু মনে মনে আমি জানব যে আমি স্বর্গে আছি। টবের ঘাসে হাত না বুলিয়ে বাইরের মাঠে হাঁটব খালি পায়ে শুধু এখন আরশান বড় হওয়া পর্যন্ত ফরমালিন, কার্বাইট আর কীটনাশক খেয়ে সুস্থ থাকতে পারলেই হয়।